গলদা চিংড়ি চাষের সুবিধা:
- গলদা চিংড়ি দ্রুত বর্ধনশীল।
- সুস্বাদু, কাটা বিহীন, সহজে রান্না করা যায়।
- স্বাদু পানিতে এবং অল্প লবণাক্ত পানিতে (লবণাক্ততা ৫ পিপিটির কম) চাষ করা যায়।
- বাংলাদেশের সর্বত্র চাষের সুযোগ রয়েছে।
- একক ও মিশ্রচাষ (কার্প জাতীয় মাছ-রুই, কাতলা, মৃগেল এর সাথে) করা যায়।
- প্রাকৃতিক উৎস ও হ্যাচারীতে উৎপাদিত রেনু পোনা বা পিএল পাওয়া যায়।
- সর্বভূক প্রাণী, খাদ্য হিসাবে সহজে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা যায়।
- বাজার মূল্য, চাহিদা বেশি এবং সহজে বিক্রয় করা যায়।
- রোগ-বালাই কম।
স্থান নির্বাচন ও পুকুরের বৈশিষ্ট্য
- পুকুর রৌদ্র আলোকিত খোলামেলা জায়গায় হাওয়া উত্তম এবং পাড়ে ঝোপ- জঙ্গল থাকলে তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
- পাড়ে বড় গাছপালা থাকলে সেগুলোর ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে এবং দিনে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা রৌদ্রালোক পড়া নিশ্চিত করতে হবে।
- ব্যবস্থাপনা সুবিধার জন্য পুকুর আয়তকার হতে হবে।
- নার্সারি পুকুরের আয়তন ১৫-৩০ শতাংশ এবং মজুদ পুকুরের আয়তন ১০০ শতাংশের মধ্যে হলে ব্যবস্থাপনা করতে সুবিধা হয়।
- নার্সারি পুকুরের গভীরতা ২.৫-৩.০ ফুট এবং মজুদ পুকুরের গভীরতা ৪-৫ ফুট হলে ভাল হয়।
- পুকুরের তলদেশ সমতল ও পচাঁ কাদা মুক্ত হতে হবে।
- বন্যামুক্ত ও বসতবাড়ীর আশে পাশে।
পুকুর প্রস্তুতি:
- পুকুরের পাড় মেরামত করতে হবে।
- প্রথমে পুকুরকে সেচের মাধ্যমে শুকিয়ে ফেলা প্রয়োজন।
- পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট গভীরতার জন্য ১৮-২৫ গ্রাম রোটেনন পাউডার দিয়ে সব ধরনের মাছ অপসারণ করা যায়।
- পুকুরের তলায় কাদা হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকলে হালকা করে কিছু বালি (দালান-কোঠা নির্মাণের জন্য যে বালু ব্যবহৃত হয়) ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। এর ফলে পুকুরের তলায় গ্যাস হবে না, পানি পরিষ্কার এবং পরিবেশ ভাল থাকবে।
- রোটেনন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
- তবে চুন ছাড়াও জিওলাইট (প্রতি শতকে ১ কেজি) পুকুর প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর শতকে ৮০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৪০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করা হয়।
পিএল/চিংড়ির আশ্রয়স্থল স্থাপন
- পিএল মজুদের ২-৩ দিন পূর্বে পিএল এর আশ্রয়স্থল হিসেবে শতাংশ প্রতি ২টি শুকনো তালপাতা অথবা ২টি শুকনো নারিকেল পাতা অথবা ২টি শুকনো খেজুর পাতা ৪৫ ডিগ্রী কোণে স্থাপন করতে হবে।
- গলদা চিংড়ি স্বজাতিভোজী। খোলস পরিবর্তনের সময় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গাছের ডাল, বাঁশের কঞ্চি, পিভিসি পাইপ, বিভিন্ন ধরণের উপকরণ ব্যবহার করা হয়।
গলদা চিংড়ির রেনু পোনা প্রাপ্তি
- আমাদের দেশে প্রাকৃতিক উৎস- নদী এবং সাগরের মোহনা থেকে গলদার রেনু পাওয়া যায়।
- এছাড়া হ্যাচারীতে উৎপাদিত গলদার রেনু পাওয়া যায়।
- মার্চ-এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত রেনু পাওয়া যায়।
নার্সারী পুকুরে চিংড়ির রেনু মজুদ
- প্রতি শতকে ২০০০টি পোনা নার্সারীতে মজুদ করা যায়। নার্সারীতে রেনু পোনা ৬০-৮০ দিন লালনের পর কিশোর গলদা চিংড়ির স্ত্রী, পুরুষ বাছাই করা যায়।
- নার্সারী পুকুরে রেনু পোনা বাঁচার হার ৮০%। মজুদকৃত রেনু পোনার শতকরা ৪০ % পুরুষ গলদা চিংড়ি পাওয়া যায়।
খাদ্য প্রয়োগ (নার্সারি পুকুরে পিএল)
চিংড়ি সাধারণত রাতে খাদ্য গ্রহণ করে তাই সূর্যাস্তের পর বা সূর্যোদয়ের পূর্বে চিংড়িকে খাবার দিতে হবে। মোট খাদ্যের ২/৩ ভাগ সূর্যাস্তের পর এবং ১/৩ ভাগ সূর্যোদয়ের পূর্বে দেয়া ভাল।
পিএল এর বয়স
(সপ্তাহ) |
চিংড়ির গড় ওজন (গ্রাম) | দৈনিক খাদ্য সরবরাহের হার (মোট ওজনের %) | মন্তব্য |
১-২ | ০.৩৩-০.৪০ | ৩০% | ৩০-৩৫% আমিষসমৃদ্ধ স্টার্টার-১ বা নার্সারী ফিড-১ |
৩-৪ | ০.৪০-১.০০ | ২৫% | |
৫-৮ | ১.০-৮.০ | ১০% | ৩০-৩৫% আমিষসমৃদ্ধ নার্সারী ফিড-২ |
৯-১২ | ৮.০-২০.০ | ৫% |
মজুদ পুকুরে পোনা মজুদ
- সার দেওয়ার ৩-৫ দিন পর পুকুরের পানির রং হালকা সবুজ হলে মাছ ও চিংড়ির পোনা মজুদ করতে হবে।
- রুই জাতয়ি মাছের আকার ১০-১৫ সে.মি. এবং চিংড়ি (পুরুষ জুভেনাইল) ৬ সে.মি. আকারের গলদা (জুভেনাইল)।
প্রজাতি | পোনার সংখ্যা/শতাংশে |
গলদা | ২৫-৩০টি |
রুই | ৮-১০টি |
সিলভার কার্প | ৮-১০টি |
কাতলা/বিগহেড | ৬-৮টি |
গ্রাস কার্প | ৩-৫টি |
থাই সরপুঁটি | ৬-৮ |
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
- গলদা ও কার্পের মিশ্রচাষে সম্পূরক খাদ্য হিসাবে চালের কুঁড়া, গমের ভূসি, সরিষা বা তিলের খৈল, ফিসমিল, মিট ও বোন মিল ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। অথবা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মাছের খাদ্যও ব্যবহার করতে পারেন।
- মিশ্রচাষে গ্রাস কার্প এবং সরপুঁটি ছাড়লে এদের খাদ্য হিসাবে ক্ষুদিপানা, কলাপাতা, বাঁধাকপি, পেঁপে পাতা, মিষ্টি আলুর পাতা ও অন্যান্য নরম উদ্ভিদ ব্যবহার করা যায়।
- ক্ষুদিপানা বা সবুজ খাদ্য দেবার জন্য বাঁশের তৈরি চারকোনাকৃতি ফ্রেম পানিতে ভাসমান অবস্থায় রাখা ভাল।
- কার্প ও চিংড়ি মিশ্র চাষে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় খাবার দেওয়া উত্তম। যেহেতু গলদা চিংড়ি নৈশভোজী তাই সকাল বেলার চেয়ে সন্ধ্যাবেলায় খাবার বেশী প্রয়োগ করা উচিত।
- খৈলের সাথে দ্বিগুণ পরিমাণ পানি মিশিয়ে এক রাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। ভেজানো খৈলের সাথে কুঁড়া মিশিয়ে বল তৈরী করতে হবে।
- ৩ ভাগ খৈল, ২.৫ ভাগ কুঁড়া এবং ২ ভাগ ফিসমিল মিশিয়ে খাদ্য তৈরী করা যেতে পারে।
- খাদ্য বলগুলো প্রয়োজনে রৌদ্রে একটু শুকিয়ে খাবার পাত্রে করে মাছের দৈহিক ওজনের ৩-৫ ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে।
গলদা চিংড়ির রোগ বালাই
রোগের নাম | লক্ষণ | প্রতিকার/প্রতিরোধ |
হোয়াইট মাসল রোগ | চিংড়ির লেজের দিক থেকে মাংস সাদা ও শক্ত হয়ে যাওয়া | পানি পরিবর্তনসহ গভীরতা বৃদ্ধি করে এ রোগ থেকে মুক্তি সম্ভব |
চিংড়ি গায়ে শ্যাওলা সমস্যা | শ্যাওলা রোগের আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। এতে চিংড়ির খোলস বদলাতে পারে না। দৈহিক বর্ধন প্রক্রিয়ায় ব্যাহত হওয়ায় চিংড়ি ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর কবলে পড়ে। | পুকুর থেকে দূষিত পানি বের করে দিয়ে নিয়মিত নতুন পানি সরবরাহ করতে হবে। পানির গভীরতা বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। |
ছত্রাক রোগ | চিংড়ির ফুলকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে চিংড়ির খোলস নষ্ট হয়ে যায়। | দ্রুত পানির পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া আক্রান্ত চিংড়ি ট্রিফ্লেন (০.২ পিপিএম) অথবা জেন্টিন ভায়োলেট (০.১-০.২ পিপিএম) দ্বারা ৩-৫ দিন গোসল করালে এ রোগের উপশম হয়ে থাকে। |
অন্যান্য ব্যবস্থাপনা
- পুকুরের পানি ভালো রাখার জন্য ১৫ দিন পর পর হররা টেনে দিতে হবে।
- চাষকালীন সময়ে শামুকের আধিক্য পরিলক্ষিত হলে শতাংশ প্রতি ১০০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগে শামুকের আধিক্য কমবে।
- অ্যামোনিয়া গ্যাস দূর করার জন্য অ্যামোনিল (প্রতি একরে ২০০ মি.লি.) ব্যবহার করতে পারেন।
- ১৫ দিনে একবার নমুনা সংগ্রহ করে গড় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে মোট খাদ্যের পরিমাণ ঠিক করে নিতে হবে।
- পুকুর/ঘেরের পরিবেশ ঠিক রাখতে প্রতি মাসে একবার পুকুরে জিওলাইট অথবা চুন দিতে হবে (শতকে ২০০ গ্রাম)।
- চিংড়ি ও মাছ নিয়মিত খাবার খায় কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
- একটানা মেঘলা আবহাওয়ায় কিংবা অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে অথবা একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে।
- পুরুষ গলদা চিংড়ির পা আকারে বড় হয় এবং অন্য চিংড়িকে সাড়াশি বা চিমটা দ্বারা আক্রমন করে ক্ষতিগ্রস্থ করে। প্রতি পনের দিন পর চিংড়ির পুকুরে বা ঘেরে জাল টেনে পা ভেঙ্গে দিতে হয়। পা ভেঙ্গে দেওয়ার ফলে অন্য চিংড়ি আক্রান্ত বা খাওয়া থেকে রক্ষা পায় এবং চিংড়ির বৃদ্ধি বেশি হয়। পা নাড়ানোর জন্য দেহের ১৫-২০% শক্তি ব্যয় হয়।
- এক পুকুরের জাল অন্য পুকুরে ব্যবহারের আগে ভাল পানির সাথে জিবাণু নাশক পটাশ মিশিয়ে পরিষ্কার করে নিন।
- অনেক সময় বক, মাছরাঙা, জলজ পাখি থেকে রোগ জীবাণুর সৃষ্টি হয়। তাই পুকুরের চারদিকে রঙিন ফিতা টানিয়ে দিন।
গলদা চিংড়ির উৎপাদন
- বর্তমানে গলদা চিংড়ির উৎপাদন বৎসরে ২০০-৩০০ কেজি প্রতি একরে।
- গলদা চিংড়ি এবং মাছ উৎপাদন করে চাষীরা প্রতি একরে ২,০০,০০০-২,৫০,০০০ টাকা লাভ করে থাকেন।
- আধুনিক পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষে প্রতি একরে ১০০০-১২০০ কেজি চিংড়ি এবং উপজাত হিসাবে ৭৫০-১০০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়।
- বাংলাদেশের সর্বত্র গলদা চিংড়ি চাষের সুযোগ রয়েছে।
*** বিস্তারিত জানার জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা মৎস্য দপ্তরে যোগাযোগ করুন।
Leave a Reply