পুকুরের স্থান নির্বাচন: যেকোনো মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুরের অবস্থান একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাছ চাষ যাতে সহজভাবে করা যায় সেজন্য পুকুর নির্বাচন বা খননের সময় নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ লক্ষ্য রাখতে হবে-
- নিজস্ব মালিকানাধীন (একক) হলে সবচেয়ে ভাল। লীজ নেয়া পুকুরের ক্ষেত্রে মেয়াদ কমপক্ষে ৩ বছর হলে ভাল হয়। তবে ৫ বছর হলে সবচেয়ে ভাল হয়।
- বন্যা মুক্ত স্থান ও ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মাছ বাজারের কাছাকাছি হওয়া উচিত।
- বাড়ির নিকটে হলে ভাল, দূরে হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হতে হবে।
- দিনে পর্যাপ্ত সূর্যালোক (৬-৮ ঘণ্টা) পানিতে পড়বে এমন স্থান।
- অল্প কাদাযুক্ত দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি পুকুরের জন্য সবচেয়ে উত্তম।
পুকুর খনন: যদি নতুন করে পুকুর খনন করতে হয় তাহলে পুকুরটি যাতে আয়তাকার বা বর্গাকার হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আবার পুকুরের আয়তন খুব বড় হলে ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য ০.৩৩ একর (১ বিঘা) হতে ০.৫০ একর (১.৫ বিঘা) পুকুর উত্তম। পুকুরটিতে যাতে সবসময় কমপক্ষে ১.৫-২ মিটার পানি থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পুকুরের পাড়ের ঢাল কমপক্ষে ১.৫:২ এবং উপরিভাগ ২.৫ মিটার চওড়া হতে হবে।
পুকুর প্রস্তুতকরণ
পুকুরের পাড় ও তলা মেরামত: পানির তলদেশে ১৫ সেমি এর অধিক কাদা থাকলে তা অপসারণ করতে হবে। পুকুরের পাড় ভাঙ্গা বা ছিদ্রযুক্ত হলে তা মেরামত করতে হবে।
জলজ আগাছা নিয়ন্ত্রণ: পানি হতে অতিরিক্ত জলজ উদ্ভিদ বিশেষ করে ভাসমান জলজ উদ্ভিদ সরিয়ে ফেলতে হবে। কিছু পরিমাণ ভাসমান উদ্ভিদ পানিতে রেখে দেওয়া ভাল কারণ গরমের সময় যখন পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায় তখন মাছ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। আমাদের দেশে জলজ আগাছা অপসারণের জন্য সাধারণত শ্রম শক্তির উপর নির্ভর করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কায়িক পরিশ্রমের সাথে অতিসাধারণ যন্ত্রপাতি যেমন- হাঁসুয়া, কাস্তে, কোদাল, ছাকনি, ঝুড়ি, দড়ি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ/প্রাণী দূরীকরণ: পানি শুকিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণী (মাছ/সাপ/ব্যাঙ ইত্যাদি) দূর করা সবচেয়ে কার্যকরী। তবে সেটি অনেক সময় সম্ভব হয় না এবং ব্যয়বহুলও বটে। সেজন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতিসমূহের যে কোন একটি প্রয়োগ করা যেতে পারে:
উপাদান | মাত্রা/শতাংশ | পানির গভীরতা | প্রয়োগ পদ্ধতি | অবশিষ্ট বিষক্রিয়ার মেয়াদকাল |
রোটেনন | ১৮-২৫ গ্রাম | ৩০ সেমি | ৩ ভাগের বিভক্ত করে ২ ভাগ পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে ও ১ ভাগ কাঁই করে ছোট ছোট বল তৈরি করে ছিটিয়ে দিতে হবে। | ৭ দিন |
তামাকের গুড়া | ০.৮-১.৫ গ্রাম | ৩০ সেমি | পাত্রে ১২-১৫ ঘণ্টা ভিজানোর পর সূর্যালোকিত দিনে ছিটিয়ে দিতে হবে। | ৭-১০ দিন |
চা বীজের খৈল | ১ কেজি | ৩০ সেমি | বালতিতে ৩-৪ গুন পানির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে সূর্যালোকিত দিনে পানিতে ছিটাতে হবে। | ৩-৪ দিন |
চুন প্রয়োগ: পুকুরে প্রতি শতকে ১ কেজি কলিচুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রথমে পানির সাথে মিশিয়ে তারপর তা সমভাবে পুকুরের পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এটি মাটির পাত্রে চুন ঘোলানোর সময় প্রথমে পাত্রটি পানি-পূর্ণ করতে হবে এবং তারপর আস্তে আস্তে পানির মধ্যে চুন ছেড়ে দিতে হবে। চুন পুকুরে প্রয়োগের সময় অবশ্যই নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে।
সার প্রয়োগ: পুকুরের পানিতে ফাইটোপ্লাংকটন উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য সার (জৈব এবং অজৈব/রাসায়নিক) প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। পুকুরে চুন প্রয়োগের অন্ততঃ ৫-৭ দিন পরে রাসায়নিক সার (শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি) ব্যবহার করতে হবে। টিএসপি সার পানিতে সহজে গলে না বিধায় ব্যবহারের ১০-১২ ঘণ্টা আগে এটিকে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পুকুর শুকনো হলে সার সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে লাঙ্গল বা আঁচড়ার সাহায্যে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
পোনার মজুদ ঘনত্ব:
পানির স্তর | প্রজাতি | প্রতি শতকে সংখ্যা |
উপরের স্তর | কাতলা | ৩-৪ |
সিলভার কার্প | ৭-১২ | |
মধ্যম স্তর | রুই | ৫-৮ |
তলদেশ/নিম্ন স্তর | মৃগেল | ৬-১০ |
কমন কার্প (মিরর/স্কেল কার্প) | ১-২ | |
সকল স্তর | গ্রাস কার্প | ২-৪ |
রাজপুটি/সরপুটি | ১০-১৫ | |
মোট | ৩৪-৫৫ |
পোনা ক্রয় ও পরিবহণ: দূরবর্তী স্থান থেকে পোনা ক্রয়ের সময় পোনার পেট খালি আছে কিনা তা অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে। এজন্য ভাল পোনা বিক্রেতারা পোনা বিক্রয়ের ২৪ ঘণ্টা পূর্বে জাল টেনে পোনা হাপায় আটকে খাবার প্রদান করে। অতঃপর হাপা থেকে পোনাগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং খাবার প্রদান বন্ধ রাখা হয়। এর ৬-৮ ঘণ্টা পরে পোনার পুকুরে কয়েকবার জাল টানা হয়। এতে করে পোনার খাদ্যনালীতে খাবারে উপস্থিতি থাকে না বললেই চলে ফলশ্রুতিতে পোনা পরিবহণে পোনার মৃত্যুর হার কমে।
পোনা শোধন: রোগ প্রবণ এলাকায় পোনার সুস্থতা ও রোগ-বালাই মুক্তির লক্ষে পোনা শোধন করে নেয়া হয়ে থাকে। এক বালতি পানিতে ১০ লিটার পানি নিয়ে তাতে ২০০ গ্রাম লবণ মিশানোর পর সেই লবণ-পানিতে পোনাকে ৩০ সেকেন্ড গোসল করানোর মাধ্যমে পোনা শোধন করা যেতে পারে।
মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
সম্পূরক খাদ্য সরবরাহঃ পুকুরে পোনা মজুদের পর থেকেই দৈনিক নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। সরিষার খৈল, চাউলের কুঁড়া, গমের ভূষি, ফিস মিল ইত্যাদি মাছের সম্পূরক খাদ্য। মাছের সম্পূরক খাদ্যে শতকরা ২০ ভাগ আমিষ থাকলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মাছের খাবার বাজারে পাওয়া যায়, আপনি চাইলে ব্র্যান্ডের মাছের খাদ্যও ব্যবহার করতে পারেন।
সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ মাত্রা: পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যতা ভেদে সম্পূরক খাদ্যের মাত্রা নির্ভর করে। তবে সাধারনতঃ মজুদ পুকুরে প্রতিদিন মাছের ওজনের ৩-৫ শতাংশ হারে ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। শীতকালে মাছের জৈবিক পরিপাক প্রক্রিয়া কমে যায়, ফলে তাদের খাদ্য গ্রহনের মাত্রা কমে যায়। তাই শীতকালে মাছ কম খায়। এজন্য শীতকালে মাছের ওজনের শতকরা ১-২ ভাগ হারে খাবার দিলেই চলে।
সার প্রয়োগ: মজুদ পুকুরে সার প্রয়োগের পূর্বে অবশ্যই প্রাকৃতিক খাদ্যের বিদ্যমান অবস্থা জেনে নেয়া ভাল। কারন সম্পূরক খাদ্য ব্যবহারের পাশাপাশি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ব্যবহার করলে পানি দূষন হতে পারে। পুকুরের মাছের ভাল ফলন পেতে হলে পানির গুনগত মান ভাল রাখার জন্য সবসময় চেষ্টা করতে হবে। তাই সার প্রয়োগের আগে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের অবস্থা জেনে নিতে হবে। এতে সঠিক মাত্রার সার ব্যবহার করা যাবে এবং পুকুরে পানির পরিবেশও ঠিক রাখা সম্ভব হবে। প্রতি মাসে শতকে ৮০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৪০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
অন্যান্যা পরিচর্যা: মাছ চাষের সফলতা অধিকাংশ নির্ভর করে পুকুরে পানির পরিবেশ ঠিক রাখার উপর। কোন রকম পঁচন ক্রিয়া যেন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। তাই যে সব পদার্থ পানিতে পঁচন ক্রিয়া ঘটাতে পারে তা যাতে পুকুরে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরে গাছের পাতা পড়ে অনেক সময় পানির পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। এর প্রতিকারের জন্য পুকুর পাড়ের গাছের ডারপালা কেটে ফেলতে হবে। নালা-নর্দমার বিষাক্ত পানি পুকুরে যাতে কোনক্রমে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য কোন উৎস থেকে আসা পানি, জাল বা অন্য কোন পাত্র পুকুরের পানিতে ধোয়া উচিত নয়। এ সবের মাধ্যমে পুকুরে রোগ-বালাই সংক্রমিত হতে পারে। অনেক সময় বাজার থেকে মাছ এনে রন্ধন কাজের জন্য পুকুরে ধুয়ে পরিস্কার করা হয়, এতে অনেক সময় পুকুরে রোগ সংক্রমণ ঘটতে পারে।
আংশিক আহরণ: সাধারণত পুকুরে সব মাছ সমানভাবে বৃদ্ধি পায় না। যেসকল মাছের বৃদ্ধি বেশি হচ্ছে ওসব মাছকে আরো বেশি বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তাই পুকুর থেকে ছোট মাছ সরিয়ে বিক্রয় করে দিতে হবে কারন যেসব মাছের বৃদ্ধি কম তাদের বড় হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
সম্পূর্ণ আহরন: নিয়মিত আংশিক আহরনের মাধ্যমে ছোট মাছ ধরার ফলে বড় মাছ আরো বড় হ্ওয়ার সুযোগ পাবে। মাছকে পুকুরে বেশি দিন না রেখে বৎসর শেষে পুরাপুরি আহরণ করে পরবর্তী বৎসরের জন্য পুকুর তৈরী করা ভাল। বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে পুকুরে যখন পানি কম থাকে তখন মাছ ধরে ফেলতে হবে।
*** বিস্তারিত জানার জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা মৎস্য দপ্তরে যোগাযোগ করুন।
Leave a Reply