পাঙ্গাস মাছ চাষের সুবিধা
- পাঙ্গাস মাছের দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে ফলে রুইজাতীয় মাছ চাষের চেয়ে পাঙ্গাস মাছের চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
- প্রতিকূল পরিবেশ (কম অক্সিজেন, পিএইচ ও পানি ঘোলাত্বের তারতম্য) এই মাছ উৎপাদনক্ষম।
- সর্বভূক বলে খাদ্যের অপচয় কম, সম্পূরক খাদ্য দিয়ে অন্যান্য মাছের সাথেও চাষ করা যায়।
- স্বল্প থেকে মধ্যম লবনাক্ত পানি (২-১০ পিপিটি) সম্পন্ন পানিতেও পাঙ্গাস চাষ করা যায়।
- ঘের, খাঁচা ও অন্যান্য মৌসুমি জলাশয়েও পাঙ্গাস চাষ করা যায়।
- স্বল্প সময়ে (৫-৬ মাসে) বাজারজাত করে মুনাফা অর্জন করা যায়।
- এই মাছ বাজারে তাজা অবস্থায় বিক্রয় করা যায়।
স্থান নির্বাচন ও পুকুরের বৈশিষ্ট্য
- পুকুর রৌদ্র আলোকিত খোলামেলা জায়গায় হাওয়া উত্তম এবং পাড়ে ঝোপ- জঙ্গল থাকলে তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
- পাড়ে বড় গাছপালা থাকলে সেগুলোর ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে এবং দিনে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা রৌদ্রালোক পড়া নিশ্চিত করতে হবে।
- ব্যবস্থাপনা সুবিধার জন্য পুকুর আয়তকার হতে হবে
স্থান নির্বাচন ও পুকুরের বৈশিষ্ট্য
- পুকুরের আয়তন ৫০-১০০ শতাংশের মধ্যে হলে ব্যবস্থাপনা করতে সুবিধা হয়।
- পুকুরের গড় গভীরতা ৫-৬ ফুট হলে ভাল হয়, যেখানে বৎসরে ৮-১০ মাস পানি থাকে।
- পুকুরের তলদেশ সমতল ও পচাঁ কাদা মুক্ত হতে হবে।
- বন্যামুক্ত ও বসতবাড়ীর আশে পাশে।
পুকুর প্রস্তুতি
- পুকুরের পাড় মেরামত করতে হবে।
- প্রথমে পুকুরকে সেচের মাধ্যমে শুকিয়ে ফেলা প্রয়োজন।
- পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট গভীরতার জন্য ১৮-২৫ গ্রাম রোটেনন পাউডার দিয়ে সব ধরনের মাছ অপসারণ করা যায়।
- পুকুরের তলায় কাদা হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকলে হালকা করে কিছু বালি (দালান-কোঠা নির্মাণের জন্য যে বালু ব্যবহৃত হয়) ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। এর ফলে পুকুরের তলায় গ্যাস হবে না, পানি পরিষ্কার এবং পরিবেশ ভাল থাকবে।
- রোটেনন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। তবে চুন ছাড়াও জিওলাইট (প্রতি শতকে ১ কেজি) পুকুর প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি তথা প্রাকৃতিক খাদ্যে বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। পুকুর প্রস্তুতির শেষ ধাপে সার প্রয়োগ করা হয়। চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর শতকে ৮০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৪০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করা হয়।
- পুকুরে কোনো প্রকার জৈব সার দেওয়া যাবে না।
পোনা মজুদ
- মার্চ থেকে নভেম্বর মাছ দ্রুত বাড়ে। তাই মার্চ মাসের মধ্যে পোনা মজুদ করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।
- সার প্রয়োগের ৪ দিন পর পানির রং সবুজ বা বাদামি হলেই পুকুরে পোনা মজুদ করতে হবে।
- প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম ওজনের ১০০-১৫০টি থাই পাঙ্গাস মাছের সুস্থ সবল পোনা মজুদ এবং ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য শতাংশ প্রতি ৫-৬টি কাতলা বা সিলভার কার্প মাছের পোনা ছাড়তে হবে।
- কার্প জাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষে প্রতি শতাংশে ৫০-৬০টি পাঙ্গাস, ৮-১০টি রুই, ১০-১২টি সিলভার কার্প ও ৩০-৩৫টি মনোসেক্স তেলাপিয়া মজুদ করলে বেশ ভাল ফল পাওয়া যায়।
- পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য গুনাবলি যাতে হঠাৎ করে বেড়ে না যায় সেজন্য পোনাকে ধীরে ধীরে কমপক্ষে ৩০ মিনিট খাপ খাইয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে।
- পরিবহন জনিত কারণে পোনার শরীরে ক্ষত হতে পারে তাই বালতিতে ১০ লি. পানি নিয়ে এর মধ্যে ২০০ গ্রাম খাবার লবণ অথবা ১ চা চামচ KMnO4 মিশাতে হবে।
- অতঃপর বালতির উপর একটি ঘন জাল রেখে তার মধ্যে ২০০-৩০০টি পোনা ছাড়তে হবে।
- যদি সম্ভব হয় পোনা ছাড়ার সময় থেকে ৫-৬ ঘন্টা পুকুরে হালকা পানির প্রবাহ রাখতে হবে।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
মাছের গড় ওজন (গ্রাম) | দৈনিক খাদ্য প্রয়োগ (মাছের ওজনের শতকরা হার) |
২৫-৫০ | ৮% |
৫০-১০০ | ৬% |
১০০-২০০ | ৪% |
২০০-৩০০ | ৩% |
৩০০-৫০০ | ২% |
- পাঙ্গাস খাদ্যে কমপক্ষে ৩০% আমিষ থাকতে হবে।
- পাঙ্গাসকে দানাদার বা পিলেট খাবার পরিবেশন অধিক সুবিধাজনক ও ফলপ্রসু।
- দানাদার খাদ্য ছিটিয়ে ও ভেজা খাদ্য বল বানিয়ে দিতে হবে।
- খাদ্যগুলো পুকুরের আয়তন অনুসারে ৪-৬ স্থানে দেয়া যেতে পারে।
- পুকুর অত্যাধিক গভীর হলে ট্রে বা খাবারদানী তৈরী করে দিলে তাতে খাদ্যের অপচয় কম হয় তবে প্রতিদিন একই স্থানে খাবার দেওয়া উচিত।
- উল্লেখ্য যে, পাঙ্গাস মাছ পানির তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে হলে খাবার গ্রহন বন্ধ করে দেয় এবং ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী হলে খাদ্য গ্রহন হার ৫০% কমে যায়।
পাঙ্গাসের সাধারণ রোগ বালাই
- পাঙ্গাস মাছ লালচে দাগ রোগে আক্রান্ত হলে ত্বক ও পাখনার গোড়ায় লালচে দাগ স্পষ্ট দেখা দেয় এবং কখনও কখনও মুখে ঘা দেখা দেয়। এ রোগে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোস্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় মাছ অস্থির ও এলোমেলোভাবে সাঁতার কাটে।
- পুকুরে পাংগাস মাছ বহিঃ পরজীবী বা ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা আক্রান্ত হলে আক্রান্ত মাছগুলোকে জাল টেনে উঠিয়ে ১ মিলি/লিটার পানিতে ফরমালডিহাইড দ্রবণে গোসল করিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
- আক্রান্ত পুকুরে শতাংশে ০.৫-১.০ কেজি হারে কলিচুন প্রয়োগ করলে পরিবেশের উন্নয়ন হয়।
- শীতকালে সপ্তাহে ১-২ দিন পরিমিত পরিমাণে ডিপ টিউবয়েলের পানি পুকুরে সরবরাহ করলে পাংগাস মাছ এ ধরণের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
- আরগুলাস বা উকুন দ্বারা পাঙ্গাস মাছ আক্রান্ত হলে প্রতি শতাংশে ৪০-৫০ গ্রাম (৪-৫ ফুট পানি) করে ডিপটারেক্স সপ্তাহে অন্তর ২ বার পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
- লালচে দাগ বা লেজ ও পাখনা পচা রোগে পাংগাস আক্রান্ত হলে ০.২৫ মি.গ্রা./লিটার মাত্রায় এক্রিফাভিন বা ম্যালাকাইট গ্রিন দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে ১-২ মিনিট গোসল করিয়ে পুনরায় পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে।
- অথবা প্রতি কেজি দেহ ওজনে ৫০ মি.গ্রা. টেট্রাসাইকিন ইনজেকশন ১ সপ্তাহে ২ বার দিতে হবে অথাব প্রতি কেজি খাবারের সাথে ১ গ্রাম টেট্রাসাইকিন মিশিয়ে ৭ দিন খাওয়ালে লেজ ও পাখনা পচা রোগ ভাল হয়।
অন্যান্য ব্যবস্থাপনা
- পুকুরের পানি ভালো রাখার জন্য ১৫ দিন পর পর হররা টেনে দিতে হবে।
- চাষকালীন সময়ে শামুকের আধিক্য পরিলক্ষিত হলে শতাংশ প্রতি ১০০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগে শামুকের আধিক্য কমবে।
- পাঙ্গাস মাছ চাষে নিয়মিত (প্রতি ১৫ দিন অন্তর ২০-২৫% পানি পরিবর্তন) পানি পরিবর্তন করতে হবে।
- অ্যামোনিয়া গ্যাস দূর করার জন্য অ্যামোনিল (প্রতি একরে ২০০ মি.লি.) ব্যবহার করতে পারেন।
- ক্ষত রোগ থেকে মাছকে মুক্ত রাখতে প্রতি মাসে একবার পুকুরে জিওলাইট অথবা চুন দিতে হবে (শতকে ২০০ গ্রাম)।
- ১৫ দিনে একবার নমুনা সংগ্রহ করে গড় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে মোট খাদ্যের পরিমাণ ঠিক করে নিতে হবে।
- মাছ নিয়মিত খাবার খায় কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
- গ্রীষ্মকালে অনেক সময় পুকুরের পানি কমে যায় এবং তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তখন অনেক সময় পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। এরকম পরিস্থিতিতে খাবার প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে।
- একটানা মেঘলা আবহাওয়ায় কিংবা অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে অথবা একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে।
- প্রতি ১৫ দিনে একবার প্রোবায়োটিক ব্যবহার করলে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে ও পানির পরিবেশ ভাল থাকবে।
- এক পুকুরের জাল অন্য পুকুরে ব্যবহারের আগে ভাল পানির সাথে জিবাণু নাশক পটাশ মিশিয়ে পরিষ্কার করে নিন।
- অনেক সময় বক, মাছরাঙা, জলজ পাখি থেকে রোগ জীবাণুর সৃষ্টি হয়। তাই পুকুরের চারদিকে রঙিন ফিতা টানিয়ে দিন।
আহরণ ও বিক্রয়
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে ৮-১০ মাস পর পাঙ্গাস মাছ ১৫০০-১৮০০ গ্রাম হয়।
- যেহেতু পাঙ্গাস অধিক ঘনত্বে চাষ করা হয়, সেহেতু ৫-৬ মাস পর যখন পাঙ্গাসের ওজন ৫০০-৬০০ গ্রাম হয়, তখনই ৫০% মজুদকৃত মাছ বাজারে বিক্রি করে দিতে হবে।
- এছাড়াও ৮-১০ মাস পর কাতলা ৮০০-১০০০ গ্রাম, রুই ৫০০-৭০০ গ্রাম ও মনোসেক্স তেলাপিয়া ২০০-২৫০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে।
- পাঙ্গাস মাছের মিশ্রচাষে হেক্টর প্রতি ৪০-৫০ মে. টন উৎপাদন পাওয়া যায়।
*** বিস্তারিত জানার জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা মৎস্য দপ্তরে যোগাযোগ করুন।
Leave a Reply