মাছ ও চিংড়ি চাষ পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি কৌশল হচ্ছে উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন। মাছ চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নিয়মগুলিকেই উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন বলা হয়। এক্ষেত্রে সামগ্রীক বিবেচনায় খামার ব্যবস্থাপনা, পোনার মান, খাদ্য ও পানির গুনাগুন, মাছ ও চিংড়ি আহরণ ও আহরনোত্তর পরিচর্যা, পরিবহন ইত্যাদি সবকিছুই থাকবে জিএপির অন্তর্ভুক্ত।
উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলনের উদ্দেশ্য:
- মাছ ও চিংড়ির গুণগতমান নিশ্চিত করা
- আন্তর্জাতিক বাজারে ও ভোক্তা সাধারণের কাছে নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য সরবরাহ করা
মাছ চাষে উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা
- মাছকে রোগ-বালাই হতে রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরণের ঔষধ প্রয়োগ করছে। এর ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে নিরাপদ খাদ্য।
- মাছকে দেয়া হচ্ছে নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিক যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। পুকুরের মাটি-পানির গুনাবলী ঠিক রাখার জন্য চাষিরা ব্যবহার করছে নানাবিধ রাসায়নিক দ্রব্যাদি যা মানবদেহের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
- মাছ চাষ ব্যবস্থাপনায় এ বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করে নিরাপদ মৎস্য উৎপাদনের জন্যই অনুসরণ করা প্রয়োজন উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন।
চাষ পর্যায়ে মাছের গুনগতমান নিয়ন্ত্রণে চাষির জন্য অনুসরণীয় ব্যবস্থাপনা
মাছ চাষ ব্যবস্থাপনায় মাছচাষিকে উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন গুলি দুই পর্যায়ে অনুসরণ করতে হবে:
- মাছ আহরণপূর্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য অনুসরণীয় ব্যবস্থাপনা
- আহরণের সময় ও আহরণের পর অনুসরণীয় ব্যবস্থাপনা
ঘের বা খামারে চাষিদের অনুসরণযোগ্য গুড প্র্যাকটিস
- গৃহপালিত পশুর খামার ও পাশ্ববর্তী বাড়িঘরের আবর্জনা হতে ঘের বা খামার কিছুটা দূরত্বে স্থাপন করতে হবে।
- খামার বা ঘের নির্মাণের সম্ভাব্য স্থানে এর আগে কোনো প্রকার কীটনাশক ও ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে কিনা কিংবা বর্তমানে কোনো জীবাণুর অস্তিত্ব রয়েছে কিনা, তাও পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
ঘের বা খামারে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত গুড প্র্যাকটিস
- খামার প্রাঙ্গণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
- এক খামারের যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে অন্য খামারে ব্যবহার করা যাবে না। একবার ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পুনরায় ব্যবহারের পূর্বে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
- গৃহপালিত পশুপাখির গোবর, বিষ্ঠা সার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
মাছ বা চিংড়ির খাদ্য সম্পর্কিত গুড প্র্যাকটিস
- নির্ভরযোগ্য উৎস হতে প্রাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য ব্যবহার করতে হবে।
- খাদ্যে ব্যবহৃত উপকরণের গুনগতমান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
- পুরনো, মেয়াদোত্তীর্ণ নিম্নমানের খাবার ব্যবহার করা যাবে না। এক মাসের বেশি পুরানো খাদ্য ব্যবহার করা উচিত নয়।
- খাদ্য গুদামে জীবাণুবাহী তেলাপোকা, ইঁদুর, বেজি, পাখি ইত্যাদির প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
- কাঁচা খাবার সরাসির ব্যবহার করা মোটেই বাঞ্চনীয় নয়।
চাষে ব্যবহৃত পানি সম্পর্কিত গুড প্র্যাকটিস
- পাশর্^বর্তী নদী, খাল-বিল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে ঘেরে বা খামারে পানি দূষণের সম্ভাবনা আছে কি না যাচাই করে দেখতে হবে।
- ঘের বা খামারের পানিতে ক্ষতিকর জীবাণু, কীটনাশক ইত্যাদি আছে কি না নিশ্চিত হতে হবে।
- নর্দমা ও কল-কারখানার দূষিত পানি যাতে ঘেরে বা খামারে প্রবেশ করতে না পাওে, তার সুব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মাছ বা চিংড়ি আহরণ সম্পর্কিত গুড প্র্যাকটিস
- আহরণের ২-৩ দিন পূর্ব থেকেই খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
- ভোরে কিংবা ঠান্ডা আবহাওয়ায় আহরণ করা উত্তম।
- সুপেয় পানি দিয়ে তৈরি বরফ ব্যবহার করাই শ্রেয়।
- আহরিত মাছ বা চিংড়ি বরফ ঠান্ডা পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে, অত:পর প্রতি কেজি মাছ বা চিংড়ি এক কেজি বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করে যথাশিগগির পরিবহনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- বরফ পরিবহনে ব্যবহৃত যাবতীয় যন্ত্রপাতি সর্বদা জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
মাছ বা চিংড়ি আহরণ সম্পর্কিত গুড প্র্যাকটিস
- তৈরী খাবারে এন্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন বা অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকলে সেক্ষেত্রে খাদ্য প্রস্তুতকারীর নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর মাছ ধরতে হবে
- জীবানুমুক্ত জাল ও আহরণ সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে হবে
- আহরণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে পারসোনাল হাইজিন মেনে চলতে হবে
- পুকুরে নামার পূর্বে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে হাত-পা জীবানুমুক্ত করতে হবে
ওষুধ ব্যবহারে গুড প্র্যাকটিস
- কেবল অনুমোদিত ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ওষুধ সংরক্ষণে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা অতীব জরুরি।
- সঠিক বিধি-নিষেধ মেনে ওষুধ ব্যবহার করাই সর্বোত্তম।
- ওষুধ ব্যবহারের সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করা একান্তই অপরিহার্য।
চাষের সামাজিক ও পরিবেশগত গুড প্র্যাকটিস
- ঘের বা খামারের বৈধ মালিকানা থাকা আবশ্যক।
- উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও প্রাকৃতিক জলাভূমি ধ্বংস করে ঘের বা খামার তৈরি করা যাবে না।
- পাশর্^বর্তী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার ক্ষতি হয়, এমন স্থানে ঘের বা খামার তৈরি করে চাষ করা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
- ঘের বা খামারের কারণে যাতে মাটি ও আশপাশের জলাশয়ের লবণাক্ততা বৃদ্ধি না পায় সে দিকে লক্ষ্য রেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
*** বিস্তারিত জানার জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা মৎস্য দপ্তরে যোগাযোগ করুন।
Leave a Reply